অর্থবাজারে প্রতিটি দিন যেন বাজারের আধিপত্য নিয়ে এক যুদ্ধ। যেদিন ট্রেডাররা মূল্যের উত্থান উদ্যাপন করে, পরদিনই পরিস্থিতি ঘুরে যেতে পারে। শুক্রবার, ন্যাচারাল গ্যাস ফিউচারের দর হঠাৎই বেড়ে যায়, যা বুলিশ ট্রেডারদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। তবে ক্রুড অয়েল একই রকম পারফরম্যান্স করতে পারেনি।
একবার আবারও নিউ ইয়র্ক মারকেন্টাইল এক্সচেঞ্জ (NYMEX) হয়ে ওঠে বড় মুভমেন্টের মঞ্চ। এপ্রিলে ডেলিভারির জন্য ন্যাচারাল গ্যাস ফিউচারের দর 0.48% বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি মিলিয়ন BTU-তে $3.99 এ পৌঁছায়। যদিও সেশনের সর্বোচ্চ মূল্য প্রত্যাশার তুলনায় কম ছিল, তবে $3.866 এর সাপোর্ট এবং $4.259 এর রেজিস্ট্যান্স মার্কেটে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং ধারণা দেয় যে এই মুভমেন্ট এখানেই শেষ নয়।
অন্যদিকে, মার্কিন ডলার সূচক — যা ছয়টি প্রধান মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দর নির্ধারণ করে — শুক্রবার ঊর্ধ্বমুখী হয়। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সূচকটি 0.28% বৃদ্ধি পেয়ে 103.79 এ পৌঁছেছিল। বহু ট্রেডারের জন্য, ডলার সূচকের মুভমেন্ট একটি নির্ভরযোগ্য সংকেত হিসেবে কাজ করে: ডলারের দর বাড়লে, সাধারণত তেল ও গ্যাসের মতো কমোডিটির ওপর চাপ পড়ে। তবে এই পরিস্থিতিতেই অনেক অভিজ্ঞ ট্রেডাররা কৌশলগত এন্ট্রি পয়েন্ট খুঁজে পায়।
তেলের বাজারে ভিন্ন চিত্র
WTI ক্রুড অয়েলের মার্কেট ততটা গতিশীলতা সৃষ্টি হয়নি। NYMEX-এ মে মাসের ডেলিভারির জন্য WTI ফিউচারের দর 0.40% কমে প্রতি ব্যারেল $68.34-এ নেমে আসে। ইউরোপিয়ান সেশনে প্রবণতা আরও নিম্নমুখী হয়, যেখানে দর আরও 0.07% কমে $68.02-এ পৌঁছায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স যথাক্রমে $66.09 এবং $68.61-এ অবস্থান করছে।
ICE-এ ট্রেড করা ব্রেন্ট ফিউচারেও চাপ সৃষ্টি হতে দেখা গেছে, যা 0.19% কমে প্রতি ব্যারেল $71.86-এ ট্রেড করা হয়েছে।
চীনে ইরানি তেলের রপ্তানি নিয়ে নতুন নিষেধাজ্ঞা
বৃহস্পতিবার, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উদ্দেশে পাঠানো ইরানি তেলের চালানকে লক্ষ্য করে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে মার্কেটে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ে। নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় স্বাধীন রিফাইনারি শোগোয়াং লুকিং পেট্রোকেমিকেল এবং একাধিক ট্যাঙ্কার রয়েছে যেগুলো চীনে ইরানি তেল সরবরাহ করে। ফেব্রুয়ারি থেকে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ নিষেধাজ্ঞা — যা ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটন আবারও তেহরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানি তেল এখন চীনে আরও জটিল এবং ব্যয়বহুল রুটে পাঠানো হচ্ছে। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, চীনা কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ পুনর্বিন্যাস করছে এবং আমদানি অব্যাহত রেখেছে।
বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে চীনে ইরানি তেল আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দৈনিক 1.43 মিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছায়, যা জানুয়ারিতে ছিল 898,000 ব্যারেল। এর একটি বড় অংশকে আনুষ্ঠানিকভাবে মালয়েশিয়ার তেল হিসেবে লেবেল করা হয় — যা বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের সৃজনশীলতাকে নির্দেশ করে।
রাশিয়া এবং ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং উৎপাদন পরিস্থিতি
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে, বিশেষত জ্বালানি রপ্তানি লক্ষ্য করে, এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য সরবরাহ সীমিত করা হলেও এটি মার্কেটে কিছু ট্রেডিংয়ের সুযোগও তৈরি করছে।
২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একট নির্বাহী আদেশে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি পুনর্বহাল করেন। মাত্র তিন সপ্তাহ পর, ২৪ ফেব্রুয়ারি, আরও এক নিষেধাজ্ঞায় ঘোষণা করা হয় যেখানে ইরানি তেল খাতের সঙ্গে যুক্ত ৩০ ব্যক্তি ও ট্যাঙ্কারকে নিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ১৩ মার্চ, আরও ১৩টি ট্যাঙ্কার এবং ১৮টি কোম্পানি ও ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হয়।
তবুও, ইরানের তেল উৎপাদন স্থিতিশীল রয়েছে। দেশটিতে ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদন ছিল দৈনিক ৪.৮ মিলিয়ন ব্যারেল, যা জানুয়ারির সমান। এটি জানুয়ারি ২০২৩ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য, কারণ তখন উৎপাদন ছিল মাত্র ৩.৭ মিলিয়ন ব্যারেল — যা এই ইঙ্গিত দেয় যে, ইরান নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কৌশল রপ্ত করেছে।
রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। ১২ মার্চ পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানিগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত ব্যাংকগুলোর (সবারব্যাংক, ভিটিবি, আলফা-ব্যাংক, সভকমব্যাংক) মাধ্যমে রাশিয়ান তেল ও গ্যাস কিনতে পারত। এই লেনদেন একটি নবায়নযোগ্য জেনারেল লাইসেন্সের মাধ্যমে সম্ভব হতো, যা প্রতি দুই মাসর পরপর নবায়ন করা হতো। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্র লাইসেন্সটি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
CBS সহ অন্যান্য বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বল্পমেয়াদে নতুন নিষেধাজ্ঞা ইরান বা রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে বড় প্রভাব ফেলবে না। তবে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক চাপ তেলের দামে সহায়ক হতে পারে। CBS অনুমান করেছে, এই লাইসেন্স বাতিল করলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে $5 পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবুও, মার্চ ১২ থেকে ২০ এর মধ্যে ব্রেন্টের দর কেবল $70.9 থেকে $71.1 পর্যন্ত বেড়েছে — যা তুলনামূলকভাবে সীমিত বৃদ্ধি।
যদি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার আর্থিক খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা হ্রাস করে, তাহলে তেলের পেমেন্ট সংক্রান্ত জটিলতা দূর হতে পারে। তবে এই ধরনের পরিস্থিতি এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
উপসংহার
উৎপাদন পরিসংখ্যান স্থিতিশীল দেখালেও, জ্বালানি বাজার ভূ-রাজনৈতিক ঘটনার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এমনকি মূল্যের সামান্য পরিবর্তনও দীর্ঘমেয়াদি ট্রেডিং কৌশলের সুযোগ এনে দিতে পারে।